এয়ারপোর্টে ছয় ঘন্টা বসে থাকা ... সো লেট মি টেল ইউ আ স্টোরি। গল্পটা নিউ ইয়র্কের, কসমোপলিটান সিটি যার বুকে পুরো দুনিয়ার মানুষ এসে ঘর বানিয়েছে।
আমার জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের এক শান্ত শহরে। সিলেটে 'জ্যাম' হয়না, সিলেটের ওয়েদার 'নাইস', সিলেট কাজ শেষে বাসের লাইন ধরতে হয়না ... এই আরামের শহরে থাকলে কারোরই হট্টগোল ভালো লাগার কথা না। এই জন্যই আমার ঢাকা ভালো লাগেনি কখনোই। চিটাগাংও হয়ত লাগত না যদি থাকতে না যেতাম। সেইটা ধরেই বলতে হয় ঢাকাও হয়ত ভালো লাগত যদি থাকতে যেতাম।
একটা শহরকে জানতে হলে সেখানে থাকতে হয়। আপনি বারবার শহরে ঘুরতে গিয়ে যতটা না ওই জায়গাকে চিনবেন, এক সপ্তাহ শুধু থাকার উদ্দেশ্যে যান, শহরটা তিনদিনের মাথায় পরিচিত হতে শুরু করবে। নিউইয়র্ক আপনাকে প্রতিনিয়ত অবাক করবে, শেখাবে। বিদেশ মানেই স্বর্গরাজ্য না, জীবনের সংগ্রামটা এখানে যে কোন অংশে কম না, বরং অনেক ক্ষেত্রে হাজার গুন বেশি, তা এই শহরটা প্রতি মূহুর্তে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবে। প্রাচুর্য্য আর অভাবের বিপরীত নিদর্শন ইউএসএর বিখ্যাত নিউইয়র্কে বারেবারে চোখে পড়বে। ম্যানহাটনের টাইম স্কোয়ার - ঝা-ঝকঝকে উঁচু উঁচু অট্যালিকা, চোখা ঝলসানো ব্র্যান্ডের দোকান, অর্থ আর প্রাচুর্যের সকল ধরনের উৎস যেখানে পাওয়া যায়। 'মানুষ অবিরত ছুটছে, এক মূহুর্ত থামার সময় নেই' এর আক্ষরিক উদাহরন আপনি সেখানে গেলে দেখবেন। এখন কেউ যদি শুধু এই ম্যানহাটন থেকেই ঘুরে চলে যান, তার কাছে মনে হতেই পারে নিউ ইয়র্ক 'হ্যাপেনিং' সিটি। কিন্তু ম্যানহাটন শহরের অর্ধেক, আসলে অর্ধেকও না, একটা অংশ খালি দেখায়। নিউয়র্কের বিখ্যাত সাবওয়েতে চড়বেন, স্টেশনের বাইরে দেখবেন মানুষজন নিঃস্ব হয়ে বসে আছে, কাপড় চোপড় ছেড়া-ময়লা। স্টেশন এরিয়াতে মানুষের মূত্রের গন্ধ, ভেতরে কাগজ ছড়ানো-ছিটানো। এসব দেশের কন্টেক্সটে দেখে আমরা অভ্যস্ত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বিদেশে 'নোংরা সিটি নিউইয়র্ক' দেখলে প্রথমবার অবাকই লাগে। বাসার পাশে যে ষ্টেশনটাতে যেতাম, ভেতরে গেলে দূরে ম্যানহাটনের এক সাইড দেখা যেত। ওই যে, বিভিন্ন হোটেলে টাঙানো দেওয়ালে রাতের আলোকিত নিউয়র্কের যে ছবি ঝোলানো থাকে। মলিন সাবওয়েতে দাঁড়িয়ে দূরের চকমকে ম্যানহাটনই নিউ ইয়র্কের পুরো চিত্রটা সম্ভবত ধরিয়ে দেয়। নেশা টেশা করে ধুত হয়ে থাকা মহিলাকে দোকানের সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কাপড়ে প্রস্রাব করতে দেখেছি, সাবওয়ের ঢোকার মুখেই কোনাটায় একটু জায়গা করে নিজের ঘর বানিয়ে ফেলা বৃদ্ধকে দেখেছি। 'অনেক মানুষ হয়ে গেছে নিউ ইয়র্কের, জায়গা দিতে পারছে না এই শহর' এর মানুষকে দেখেছি।
এই মানুষই নিউইয়র্কের সবচে' সুন্দর আর প্রধান চিত্রটা তুলে আনে। পুরো বিশ্বের এমন কোন দেশ সম্ভবত নেই যার একজন হলেও মানুষ এই শহরে নেই। পুরো দুনিয়ার মানুষকে এই সিটি ধারন করেছে, এরাই এই শহরের ট্রেডমার্ক। দারিদ্র্য, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে বেঁচে থাকা দেশেও দেখে এসেছি। কিন্তু এখানে অন্য রকম বোধ হয় যখন পুরো বিশ্বের মানুষের জীবনের চিত্রটা এক হয়ে ধরা পড়ে। এশিয়ান, স্প্যানিশ, আফ্রিকান, হোয়াইট সবাই প্রতিদিন চেষ্টা করছে, যাতে ভালোবাসার মানুষেরা একটু হলেও ভালো থাকে। দেশ ভিন্ন, জাতি ভিন্ন, ভাষা আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা, কিন্তু পরিবার, সন্তান, বন্ধন এই ধারনাগুলো সবার জন্য সমান। কষ্টের রঙটাও এক, সংগ্রামের চিত্রটাও তফাতহীন। দারিদ্রের যে কোন দেশ থাকেনা, দারিদ্র যে একটা অবস্থা তাও নিউইয়র্ক বুঝিয়ে দেয়। ধনী দেশ আর গরীব দেশ দুই দেশ থেকে এসেই মানুষ নিউ ইয়র্কে সংগ্রাম করছে, দারিদ্রের যুদ্ধটা অভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
মানুষের সহাবস্থানের এই আরেক নিদর্শন নিউ ইয়র্ক। দেশ-জাতি, ধর্ম, বর্ন, বিশ্বাসের ভিন্নতা নিয়েও মানুষ একসাথে আছে। এখানে বিশ্বাসী আছেন, অবিশ্বাসী আছেন, সমকামী আছেন আবার তাদেরকে দেখতে না পারা মানুষজনও আছেন। একই রাস্তায় বোরখা পড়া মহিলা আবার শর্ট প্যান্ট পড়া কোন মেয়ে একসাথে হেঁটে যাচ্ছেন। এদের অনেকেই হয়ত ভেতরে ভেতরে একজন আরেকজনকে পছন্দ নাও করতে পারেন, অন্যের দর্শনে একমত নাও হতে পারেন, তাকে মনে মনে দুইটা গালিও দিতে পারেন, কিন্তু কারো সাধ্য নেই আরেকজনের স্বাধীনতায় এসে হস্তক্ষেপ করার। সে কিভাবে চলবে, কিভাবে বলবে আর কিভাবে তার জীবনাচরন হবে তা আমার চেয়ে ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু আমার এখতিয়ার নেই তাতে নাক গলানোর। রাষ্ট্র আমাকে এই ক্ষমতা দেয়না, রাষ্ট্রই তার নাগরিকের এই স্বাধীনতার জায়গাটা রক্ষা করে। নিউইয়র্ক এখানেই আরেকটা জিনিস চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় - জাতি, ধর্ম, বর্ন, বিশ্বাস, মতবাদ নির্বিশেষে মানুষ এক 'ছাদের তোলায়' থাকতে পারে যদি রাষ্ট্র উদার হয়, আন্তরিক হয়, রাষ্ট্র প্রটেকশন দেয়, আইন-কানুন বানায় আর তা রক্ষা করে।
কাল হো না হো মুভিতে প্রথমেই একটা ডায়লগ থাকে যে নিউ ইয়র্কের দুই পা গেলেই ভারতীয় চোখে পড়ে। এখন ভারতীয়দের জায়গায় বাংলাদেশী বসিয়ে দিলেই ব্যাক্তগত অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে। নিউয়র্কে পা বাড়ালেই বাংলাদেশী দেখেছি। সাবওয়ে, রেস্টুরেন্ট, কাপড়ের দোকান, রাস্তাঘাট - এমন কোন জায়গা নেই যেখানে তারা নেই। যেহেতু বাংলাদেশীরা বাইরের জবগুলো বেশি করেন, তাই যে দোকানেই গিয়েছি, তাদের দেখা মিলেছে। বাংলাদেশী আর নিউইয়র্কের একটুকরো বাংলাদেশের গল্প অন্য কোন এক দিনের জন্য থাকুক।
আমাদের মায়ের জ্যানারেশন ছোটবেলায় ভাবতেন আমেরিকা মাটির নিচে থাকে। নিজের ছোটবেলায় নিউ ইয়র্ক, শিকাগো এই বড় বড় নামগুলো শুনতে শুনতে আর হোটেলে ইউ ইয়র্কের বিল্ডিং এর ছবিগুলো দেখতে দেখতে নিজে যখন এখন এসবের রাস্তা দিয়ে হাঁটি, ভাবি যে জীবন আসলে অনেকটাই কাটিয়ে এসেছি। সবচে' অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এই বড় জায়গাগুলোয় আসার আগে যে আকর্ষন লাগে, সেখানে পৌছার পর আর তেমন কিছু বোধ হয়না। তবে হ্যা, মানুষ দেখেছি। বহু রকম, বহু মতের। মানুষ অদ্ভুত হয়, বিরক্তিকর হয়,
তবে বেশিরভাগ সময়েই মানুষ মায়ার হয়।
তবে বেশিরভাগ সময়েই মানুষ মায়ার হয়।
একজন মানুষ হিসেবে, মেয়ে হিসেবে স্বাধীনভাবে চলার যে আনন্দ সেটা দেশে অনেকক্ষেত্রেই হয়না প্রেক্ষাপটের কারনে, এখানে যেটা পাই। নিউ ইয়র্কও ব্যতিক্রম ছিলনা। তবে হ্যা, একটা জিনিস বড় পীড়া দিয়েছে, রাস্তা ঘাটে চলতে বেকায়দায় ফেলেছে। নিউইয়র্কের কবুতর। কবুতর ভীতি আমার কেমন সেটা কাছের মানুষেরা জানেন। নিউইয়র্কের কবুতরের একটা শুমারি হওয়া দরকার ছিল। কত কষ্ট করে যে এদেরকে পাশে কাটিয়ে চলাফেরা করেছি।
একদম বিশ্রীভাবে, খোলামেলাভাবে এরা ঘুরে বেড়ায় পুরো শহর জুড়ে, রাস্তা জুড়ে!
একদম বিশ্রীভাবে, খোলামেলাভাবে এরা ঘুরে বেড়ায় পুরো শহর জুড়ে, রাস্তা জুড়ে!
No comments:
Post a Comment