ঘাসের ডগায় জমে থাকা কুয়াশার জলবিন্দুর ওপর অস্পষ্ট সূর্যালোক প্রতিবিম্বিত হয়ে অপার সৌন্দর্যের আলপনা তৈরি করে মধ্য কার্তিক জানান দিচ্ছে শীত এসেছে। তবে কুয়াশার আঁচল সরিয়ে শিশিরবিন্দু মুক্তোর দানার মতো দ্যুতি ছড়াতে শুরু করলেও শীতের আসল মজা পেতে এবার খাগড়াছড়ি সাজেক পাহাড় থেকে আরো উপরে কংলাক টিলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শুভ্র। অবশ্য বন্ধুবর আলী সাহেব প্রথম সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তাব দেয় শুভ্রকে। শুভ্র’ও যেন মনে মনে এইরকম একটা কিছুর পরিকল্পনা করছিলো।
অনেক দিন যাবত অফিস এবং ব্যবসা নিয়ে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলো সে। তারপর খোশবু এবং বিন্দু’র ঘন ঘন মোবাইল তাকে বিদ্ধস্ত করে তুলছিলো। এই বিন্দুই যে শুভ্র’র ছোটো বেলার খেলার সাথী এবং ভলোবাসার বিন্দু, এটা সে বেশ ভালো করেই বুঝতে পেরে গিয়েছিলো। কিন্তু কেনো এবং কীসের অভিমানে সে তার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখছে? একদিন যাকে সে একেবারেই একজন অকৃত্রিম বন্ধুর মতো ভালো বেসেছিলো, সেই তার প্রতি শুভ্র’র এতো গোস্বা কেনো? এহেন গোস্বার আড়ালে কী তবে অন্য কোনো কিছুর আবেদন আছে? আজ অনেকদিন পর অন্য আলাদা দিন গুলো থেকে বেশ ভালো লাগছিলো শুভ্র’র। কিন্তু খোশবু মেয়েটি, কে? যার চেহারার সাথে পেন চানের হুবহু মিল খুঁজে পায় শুভ্র।
এমনি একটা সময়ে অস্থির সময়ে বন্ধুবর আলী সাহেবের খাগড়াছড়ি সাজেক পাহাড়ের সর্বোচ্চ টিলা কংলাক যাওয়ার প্রস্তাবটি লুফে নেয় শুভ্র। আর কিছু না হোক অন্ততঃ শহরের কঠিন ব্যস্ততা থেকে দূর পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সবুজে ঘেরা পাহাড়, আর বন বনানীর সাথে মিলেমিশে থাকা জলভেজা বাতাসে নিজেকে একাকার করে প্রকৃতির মতো ভিন্ন রকম সজীবতায় ঝরঝরে ও তরতাজা করার একটা বিশ্বাস নিয়ে আজ রাতে সড়ক পথে রওয়ানা করে সে। মনে যেনো আজ নুতন করে বসন্ত বাসা বেধেছে।
অবিশাস্য হলেও খাগড়াছড়ির সড়ক পথের রাস্তা এতো সুন্দর তা কল্পনার বাইরে ছিল শুভ্র’র। মসৃন রাস্তা, বিশ্বাসের বাইরে বলা যায়। চট্টগ্রামের মীরসরাই পেরিয়ে গাড়ি যখন খাগড়াছড়ির পথে, তখন পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথের রূপ মুগ্ধতায় শুভ্রর চোখ বুজিয়ে দিচ্ছিলো বারবার। পথের ধারে ছড়িয়ে আছে কতো সৌন্দর্য। যেটা গাড়ির হেড লাইটে বেশ ভালোকরেই বোঝা যাচ্ছিলো। উঁচু-নিচু টিলা, জুমের সবুজ ফসল, আদিবাসি পল্লী, তাদের টং দোকান, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ মন্দির, পাহাড়ি গভীর খাদ, আর পাহাড় ছুঁয়ে যাওয়া মেঘ। আবার যেন ওই দূর পাহাড়ের সঙ্গে গভীর মিতালী করেছে আকাশের নীল।
পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো একটা চ্যালেঞ্জের মতো। এখানে গাড়ি একটা নির্দিষ্ট গতির নিচেও চালানো যায় না, আবার পাহাড়ি রাস্তার বাঁক গুলোও সাবধানে পার হতে হয়। একটু এদিক-ওদিক হলেই ‘নো সেকেন্ড চান্স!’
তাই ভয়ংকর সুন্দর এ রাস্তায় গাড়ি চলাতে একটু বেশিই সাবধানী ছিলো গাড়ির ড্রাইভার। গাড়ি যখন সাজেক পাহাড়ে গিয়ে পৌছালো তখন ভোরের আলোতে নীচে চোখ বুলাতেই মনে হলো দু-দুটো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। একটা পাহাড়ের ওপরে, আর একটা পাহাড় থেকে গভীরে প্রায় এক হাজার আটশত ফিট নীচে। আর এই পাহাড় টি হ’ল সাজেক ভ্যালির সর্বোচ্চ চূড়া। যে পাহারের সৌন্দর্যবোধে চোখ ফেরানো খুব মুশকিল। পাহাড়ের একপাশ থেকে আরেকটা পাশের যে সৌন্দর্য, তা অনন্য। হয়তো তাই, পাহাড় মানুষকে টানে অন্যরকম এক দুর্নিবার আকর্ষণে। সুনসান বাতাসে দুরের পাহাড় থেকে পাহাড়ী একটা মেয়ে মধুতে বেদনা মাখা গান গাইছে অন্যরকম এক বিরহবোধে।
একজন পাহাড়ীকে ঐ গানের অর্থ জিজ্ঞেস করতেই পাহাড়ী ছেলেটা যেটা বললো, সেই অর্থে বাঙলা অর্থটা হ’ল এমন-
মনে বড় আশা ছিলো রে
তোরে কইরবো রে বিয়া..
কেনে ভুল বুইঝলে রে জুমের ছেলে
কাইন্দে রে মোর হিয়া, মনে বড় আশা ছিলো রে..!
আসলে ভালোবাসার যেমন কোনো জাত হয় না, তেমনি চোখের জলেরও কোনো রঙ হয় না। যে ভালোবাসায় বিরহের বিচ্ছেদ যত বেশী, সেই ভলোবাসায় কষ্টবোধের অন্যরকম একটা অনুভূতি তত বেশী হৃদয়কে আলোড়িত করে। বিষন্নতার ভেতর চুপ থাকা সুখগুলোকে বীণার তারে সুরের ঝংকারের মতো নাড়া দেয়। সুরগুলো যতই করুণ হয় ততই এর আবেদনকে আবেগায়িত করে আরো মধুময় করে তুলে।
তাহলে খোশবু এবং পেন চান, এরা তবে কে? এরা কী তবে উভয়ে উভয়ের প্রেতআত্বা? নাকি অন্য কিছু? এদের প্রতি শুভ্র’র মনের অবস্থাটা এতো টান টান কেনো? মাঝে মধ্যে নানান সব অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে শুভ্র, কিন্তু প্রায় একই রকম আদলে দুটি আলাদা আলাদা মেয়ের চেহারা, দেখতে একই রকম হবে, এটা নিজে না দেখলে সে নিজেও হয়তোবা বিশ্বাস করতো না। কিন্তু আচরণে দুজনের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য দেখতে পায় সে। খোশবু ধীর-স্থীর গতি সম্পন্ন এবং বেশ মার্জিত স্বভাবের। কিন্তু পেন চান অত্যন্ত চঞ্চল। স্থীরতা বলতে কিছুই নেই যেন। অনেকটা অস্থির আচরণের। সরলমতি খোলা মনের একটি মেয়ে। হাল্কা একটু অভিমান থাকলেও তার ভেতর আবার প্রচন্ড একটা ভালোবাসা বসবাস করে। সে তার সমস্ত পবিত্রতা দিয়ে শুভ্রর’ চোখে চোখ রেখেছিল। কিন্তু শুভ্র তার সমস্ত মুখাবয়বে আর একজনকে কল্পনা করছিলো। পেন চান সাদা মনে তার সমস্ত নিবেদনের কথা প্রকাশ করছিলো। আর শুভ্র পেনচানের মনের ভেতর ঢুকে উপলদ্ধি করার চেষ্টা করছিলো, দুই এর মধ্যে হাজার রকমের পার্থক্য। এখনও কেনো যেন পেন চানের সকল রকম নিবেদন পাহাড়ী মেয়েটার গানের সুরের মতো ভেসে আছে শুভ্র’র কানে,
মনে বইড়ো আশা ছিলো রে
তোরে কইরবো রে বিয়া..
কেনে ভুল বুইঝলে রে জুমের ছেইলে
কান্দে রে মোর হিয়া, মনে বইড়ো আশা ছিলো রে..!
শুভ্র সাজেক পাহাড়ের সর্বচ্চ টিলা কংলাক এর উপর একটি মাত্র দাড়িয়ে থাকা খুব ছোট্ট কাঁঠাল গাছ, সেই গাছের ডাল দুই হাতে ধরে দুর পাহাড়ের বনে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে অজান্তে পেন চানকে নিয়ে অন্যরকম একটা মোহনীয়তায় ডুবে গিয়েছিলো, খেয়াল করেনি। আস্তে ধীরে এক সময় পশ্চিমের আকাশে এক থালা রক্ত মুখে সুর্যটা বিদায় নিতে থাকে। আর চাঁদটা নব বধুর মতো ঘোমটার আড়ালে উঁকি দিতে থাকে। আজকের রাতের মতো সবাই যে যার মতো রিসোর্টে গিয়ে উঠে। শুভ্রও তার রিসোর্টটিতে গিয়ে উঠে। সবাই যখন ঘুমে, শুভ্র তখন লুকিয়ে লুকিয়ে পাহাড়ী বুনো বনের রুপসুধা পানের জন্য তার রুমের ছোট্ট বারান্দায় দাড়িয়ে একা একা জেগে থাকে। এখন পাহাড়ে কেবল শূন্যতা। জোছনার রজত ধারার স্নিগ্ধতা ছাপিয়ে রেখেছে অরণ্যকে। অরণ্যের গহিনে পাখিরাও ঘুমিয়ে পরেছে। শুধু একা, একেবারে একা জেগে আছে শুভ্র।
ইদানীং শুভ্র’র মনের অবস্থা একেবারে পোয়া বারো। শহর আর ভালো লাগছিলোনা শুভ্র’র কাছে। তাই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে চায় মন নিভৃত পল্লীর কোনো এক কোণে, যেখানে তার নাড়ি পোঁতা আছে, যেখানে শুয়ে আছে মা। শুভ্র’র জন্য পেতে রেখেছে ঘন সবুজ আঁচল। মা বেঁচে থাকতে মাঝে মধ্যেই বলতো, তোমার আব্বা মারা যাওয়ার কত বছর হয়ে গেলো, তোমরা ঠিকমতো কবর জিয়রত পর্যন্ত করনা। আমি মারা গেলে তোমরা সবাই শধু কবরটাতে কোনো মতে শোয়ায় দিয়ে আর কোনো খোজ খবরই রাখবেনা এ আমি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি। শভ্র’র মন অস্থির হয়ে উঠে। মন ছুটে যায় সেইখানে যেখানে মা’ তার সবুজ আঁচল পেতে শুয়ে আছে। শুভ্র আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ছুটে চলে মায়ের কাছে। ওখানে খুব কাছেই শুভ্র’র বাগান বাড়ি। বাগান বাড়ির কাছ ঘেঁসে বয়ে চলেছে ছোট লাছি নদী। বাগান বাড়ির এই নদীর কিনারেই শুভ্রর’র আছে একটা ডুপ্লেক্স টাইপ বাংলো বাড়ি। রাতে জোছনার আলোয় এর ছাদে উঠলেই দেখা যায় বাঁশ বন। তার মাথার উপর দোলনায় দোল খাচ্ছে চাঁদ, চোখে পরে বয়ে চলা নদীর ঝিলেমিলে। এর থেকে অল্প একটু দুরে হেটে গেলে বড়জোর দুই তিন মিনিট লাগবে মা এবং আব্বার কবর। যেখানে যাপিত জীবনের সবকিছু ছেড়েছুড়ে পরম শান্তিতে এবং নিশ্চিন্ত ঘুমে শুয়ে আছে তারা। চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট করে হলেও বেশ চোখে পরে। শুভ্র’রও মনে হয় মা যেন তার কাছেই আছে।
আর তাই, শুভ্র সাজেক ভ্যালি থেকে ঢাকায় ফিরে এসে পুরো কটা দিন বাসায় চুপচাপ বসে থাকে।
এরপর সে মনস্থির করে আগামীকাল রাতেই সে তার গ্রামের বাড়ি যাবে। আর আজ তাই পুরো একটা রাত নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে সরাসরি সে তার বাগান বাড়িতে না গিয়ে মা এবং আব্বার কবরের কছে গিয়ে দাড়ায়। দু হাত হাত তুলে ধরে আল্লার কাছে। তাদের আত্মার শান্তির জন্য পরম করুণাময়ের দরবারে দোয়া করে, আল্লা- হুম্মা রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা। এরপর সেখানে বেশ কিছু সময় ঘুড়ে ঘুড়ে দেখে মা বাবার কবর। সেই কবরের কাছ ঘেসে থাকা সবুজ ঘাসের উপর দীর্ঘ সময় বসে থাকে। মায়ে শাড়ির আঁচলের মতোই যেন অবিরাম এক পশলা শান্তির হাওয়া এসে শুভ্র’র মন কে সতেজ করে তুলে। এরপর আস্তে ধীরে সেখান থেকে শুভ্র তার বাংলো বাড়িতে চলে যায়। দাড়োয়ান তো শুভ্র কে হঠাৎ এভাবে আসতে দেখে অবাক। সাহেব তো কখনও তাকে না বলে এভাবে আসেনা। আজ কী হয়েছে সাহেবের? দাড়োয়ান ভয়ে ভয়ে শুভ্র’র কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে, সাহেব আপনি তো আমাকে তেমন করে আপনার আসার কথা কিছুই বলেননি?
শুভ্র বলে, না রে! মনটা কদিন থেকেই ভালো যচ্ছিলো না। ভাবলাম কটা দিন গ্রাম থেকে ঘুড়ে আসি। তাই চলে এলাম। এখন বেশ ভালো লাগছে এখন।
দাড়োয়ান বাবুর্চি কে ডেকে নিয়ে এসে শুভ্র’র জন্য নাস্তা রেডি করে। শুভ্র একটু ফ্রেশ হয়ে তা’র পছন্দ মতো সালাদ জাতীয় নাস্তা খেয়ে শোয়ার খাটের কাছে গিয়ে শরীর টা এলিয়ে দেয়। দখিনের জানালা দিয়ে তখন সূর্যটা উঁকি মারছে। ছোট লাছি নদীর থীর থীরে জলে নর্তকীর ছন্দে সূর্য কিরণ ধ্রুপদি তালে নাচছে। ভোরের সূর্যের আলো আর শীতের কুয়াশার মাখামাখি করে পখিরা মনের আনন্দে বেজায় রকম সুর তুলে এ ডালে ও ডালে উড়ে উড়ে ভোরের প্রকৃতিকে মাতাল করে রেখেছে। আর সেই গানে গানে ক্লান্ত শুভ্র অনাবিল শান্তির এক মোহনীয় ঘুমে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছে।
দুপুরে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে ডাইনিং রুমে যায় শুভ্র। অনেক দিন পর লাকরী দিয়ে রান্না করা ভাত খায় শুভ্র। লাকরী রান্নার ভাত খাওয়ার স্বাদ অন্যরকম। কিন্তু মা’এর হাতের রান্নার স্বাদ আজোওবধী সে কোথাও পায়নি। অতলুনীয় একটা স্বাদ যেনো মুখে লেগে থাকে।
খাওয়া সেরে শুভ্র বারান্দায় পেতে রাখা ইজি চেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দেয়।
এর একটু পরেই বামন জাতীয় একটি ছেলে শুভ্র কে দেখতে পেয়ে তার কাছে এগিয়ে আসে।
ওকে দেখেই শুভ্র’র মনে পরে যায় অতীত দিনের একটা ভয়াবহ স্মৃতি মাখা আতংকের কথা। বামন ছেলেটির নাম আব্দুর রহিম। শুভ্র তাকে রহিম বলে। শুভ্রদের বাড়িতে অনেক দিন থেকে রাখাল হিসেবে কাজ করতো সে।
ইদানীং ক্ষমতাসীন নেতারা ক্ষমতা আঁকরে রাখার জন্য নানারকম ফন্দি ফিকির করে। তৃণমূল পর্যায়ে হরেক রকম কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির ইশতেহারে থাকে গ্রাম তথা জনগণের উন্নয়নের নানান সব চটকদার ভিশন। আর নয় ডাল ভাত, এবার হবে মাছ ভাত। এমন সব হাস্যকর ছন্দে নানান সব লেখা। গণতন্ত্র সমুন্নত রাখার জন্য তাদের নিজ দলের কোনো বিকল্প নেই। আর এই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্যই আজকের এই কমিটি গঠন। অথচ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মাছ ভাত তো দুরে থাক, ডাল ভাত খাওার জন্য একটি থালা পর্যন্ত ক্রয়ের সামর্থ্য থাকেনা। সেখানে এই কমিটি গঠন জনগনের কাছে এক চরম প্রতারণা এবং ধোকবাজীর সামিল। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে হলে এমন কমিটি গঠন যে অত্যবশ্যক। এমন সব আদর্শ উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামের সহজ সরল মানুষদের নিয়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয় সভা। সভাপতি, সেক্রেটারী ও অন্যন্য সদস্য মিলে একটি কমিটি গঠনের কাজ শুরু করে।
শুভ্র’র বয়স তখন সবে দশ কী এগারো হবে। শুভ্রও সেই মিটিং এ হাজির। কিন্তু একটু পরেই তার চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু করতে থাকায় সে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষের ভেতর হাই বেঞ্চ এর সাথে লাগোয়া লো বেঞ্চটিতে শুয়ে পরে।
এর পর কখন কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়েছে এবং উপস্থিত লোকজন সবাই কখন চলে গেছে, সে সবের সে কিছুই বলতে পারেনা শুভ্র। হঠাৎ-ই স্কুল কক্ষের ভেতর প্রচন্ড ভাবে বেঞ্চ উল্টে পরার ঠাস ঠাস আওয়াজে শুভ্র’র ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে তখনও ঠাহর করতে পারছিলোনা সে কোথায় আছে। কিন্তু শব্দের আওয়াজ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।
শুভ্র সেই ছোট বেলা থেকেই বেশ সাহসী ছিল। অল্পতে ভয় পাওয়ার মতো ছেলে সে মোটেই ছিলনা। কিন্তু শুভ্র আজ একটু ভয় পেয়ে যায়। এরই মধ্যে তার মনে পরে যায় সব কিছু। কিন্তু স্কুল কক্ষের ভেতর এতা শব্দ কিসের? শুভ্র চটজলদি দরজার কাছে যায় ওখান থেকে বের হয়ে আসার জন্য। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে সে দেখতে পায় মধ্র রাতের শেষে ছোট একটি ছেলে গুর গুর করে ছোট ছোট পায়ে তার সামনে দিয়ে হেটে যাচ্ছে। অথচ শুভ্র যে পথে বাড়ি যাবে সেই পথেই সেই ছেলেটি হেঁটে যাচ্ছে। কোনো টু শব্দটিও করছেনা সে। শুভ্র’র পুরো শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখে আলো আঁধারী অন্ধকারের মধ্যে আরো বেশী করে যেন অন্ধকার দেখতে থাকলো। এই মহুর্তে তার কী করা উচিৎ ঠাহর করতে পারছিলোনা। সেই ছোট বেলা থেকেই শুভ্র’র বাঁশী বাজানোর একটা শখ ছিলো। অস্ত্র হিসেবে সেই বাঁশীটিই শুধু তার হাতে আছে। শুভ্র ছোট বেলায় শুনেছে ভূত বা সেরকম কিছু দেখলে পেছনে যাওয়া যায়না। সাহস করে সামনেইে এগিয়ে যেতে হয়। শুভ্রও এবার তাই করলো। শুভ্র যতই এগুতে থাকে সেই ছোট্ট ছেলেটি ততই তরিতে আরো সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। কছেই একটা লিচু গাছ ছিলো। শুভ্র সামনে তাকিয়ে দেখলো ওখানে ভূত ছেলেটি আকারে আরো বিশাল বড় হয়ে গেলো। শুভ্র’র তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া। এবার বুঝি আর বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। তোবুও শুভ্র শেষ একটা চেষ্টা হিসেবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়, পেছনে নয় বরং সামনের ঐ লিচু গাছের ছায়ার ভেতর দিয়েই সে যাবে। এ ছারা আর অন্য কোনো পথ নেই। এতে যদি তার কোনো কিছু হয় হোক তারপরও সে এগিয়ে যাবে, নয়তো মৃত্যু অনিবার্য। শুভ্র তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বড় বড় আওয়াজ করে কাশতে কাশতে এগিয়ে যায়। কিন্তু ভূত ছেলেটি আবারও দ্রুত এগুতে থাকে। এবং এক সময় শুভ্র ঐ ভূতটাকে আর দেখতে পায়না। শুভ্র কেনো রকম বাড়িতে গিয়ে সবাইকে জাগিয়ে তুলে। সবাই শুভ্র’কে বকা দিতে থাকে। অনেকেই জানে ঐ স্কুলটাতে একটা ভূতের বাস আছে। তাই সহজে কেউ ওখানে পারত পক্ষে রাতের বেলা ভূল করেও যায়না। তোবুও সবাই শুভ্র’র কাছে বিস্তারিত সব শুনে দল বেধে দেখার জন্য সেখানে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে সকলে দেখতে পেলো ভিতর থেকে বড় ছোট বেঞ্চগুলো সব উপর নীচ করে থরে থরে ফেলানো। কিন্তু ভূতের তেমন কোনো কিছুই আর দেখা গেলোনা।
পরদিন সকালে শুভ্র রাস্তার ধারে বৈঠক ঘরের বারান্দায় বসে গতকাল রাতের ভূতের গল্পটা সবাইকে শোনাচ্ছিল। আর ঠিক ঐ সময় বামন রহিম ওখানে এসে হাজির। তারপর সবার সামনে বামন রহিম যা বললো, তা শোনে সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আসলে ওটা ভূত ছিলোনা। ওটা ছিলো বামন আকৃতির রহিম। সেও ঐ রাতে শুভ্র’র মতো স্কুল রুমের একেবারে ভেতরে ছোট একটি বেঞ্চে ঘুমিয়ে পরেছিলো। কিন্তু যখন সে জেগে উঠে দেখলো যে, আশপাশে কমিটি গঠন এর কোনো লোক-ই নেই, তখন সে ভয়ে ওখান থেকে বের হয়ে আসতে চাইছিলো। কিন্তু বাধ সাধলো বড় বড় হাই বেঞ্চগুলো। যেগুলো সে কোনোভাবোই ডিংগীয়ে আসতে পার ছিলোনা। তাই সে উপায়ন্তর না পেয়ে একটার পর একটা হাই বেঞ্চ উল্টে উল্টে ফেলে সেগুলোর উপর লাফ দিয়ে দিয়ে পার হয়ে আসছিলো। আর সেই শব্দে শুভ্রও জেগে উঠেছিলো। শুভ্র’র জোরে জোরে কাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো। অন্যদিকে বামন রহিম তার দিকে তেরে আসতে দেখে মনে করেছিলো শুভ্র হয়তো ভূত হবে।
আর শুভ্রও বামন রহিমকে দেএবং বেঞ্চ এর শব্দে মনে করেছিলো বামন রহিমই হয়তো ভূত হবে। লিচু গাছের ছায়ায় শুভ্র লম্বা মতো যেটা দেখেছিলো, সেটা বামন রহিমেরই ছায়া। আলো অন্ধকারের মধ্যে ঘনীভূত হয়ে লিচু গাছের ছায়ার ভেতর একটি বিড়াট আকারের ভূত ভূত ভয়ের চিত্র মনের মধ্যে এঁকে নিয়েছিলো মাত্র।
ঠিক এমনি একটি অসহায় অবস্থার মধ্যে দেশের মানুষ তথাকথিত গণতন্ত্রের ভূত বিষয়ে আজ আতঙ্কিত। সদা তটস্থ। এ কোথায় আমরা বাস করছি ? যে রক্তে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন, সেই রক্তকেই নেতৃত্বের বিশিষ্ট জনেরা পুঁজি করে বার-বার তাকে হত্যা করছে, খুন করছে। বাহ্ বাঙালি, বাহ্! কী চমৎকার এই দেশ! শধু কী তাই, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সেক্টর কমান্ডার কে পাকিদের দালাল বানিয়ে দেশে অসাম্প্রদায়িকতার ধুঁয়া তুলে নিজেদের সাম্প্রদায়িকতার পোড়া কাষ্ঠে অক্টপাশের মতো জড়িয়ে একটা বিপদজ্বনক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। কেননা মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তি যোদ্ধারা কোনো একটি বিশেষ দলের নয়। এরা একাত্তোরের সকল মুক্তিকামী দলের এবং বাংগালির বাংলাদেশের।
যাইহোক, শুভ্র যখন খাওয়া সেরে বারান্দায় পেতে রাখা ইজি চেয়ারে নিজেকে এলিয়ে দিয়েছে, তখন সেই ভুত রহিম আস্তে ধীরে শুভ্র’র কাছে এসে দাড়ায়। এরপর ছালাম দিয়ে তার কাছে গিয়ে বলে, দাদা কত দিন তোক মুই দেখুনি। তোক দেখিলেই মোর স্কুলের ভুতের কথা মনে পরে যায়।
শুভ্র হেসে বলে, মরোহ একই রকম মনে হয় রে রহিম।
রহিমঃ দাদা তুই কী আর গ্রামত থাকিবোনি?
শুভ্রঃ ইচ্ছা তো হয়, কিন্তু ঐঠেও তো অনেক কাজ।
রহিমঃ দাদা তুই চলে আয়। তোর যত জায়গা জমি, বিড়াট বিড়াট বাগান, আর ইটের বাড়ি, এইলায় তো মেলা। ঐঠে তোর থাকার কী দরকার !
শুভ্রঃ ঠিক কহিচি, খুব তারাতারি চলে আসিম। খাইচি কিছু?
রহিমঃ না দাদা এলাও খাউনি।
শুভ্রঃ কী খাবো, কোহো।
রহিমঃ না, দাদা। কিছু খামনি। চায়ের দোকানত যায়হেনে একটা পাউরুটি আর চা খাইলেই হয় যাবে। রহিমের এই কথায় শুভ্র’র মনে পরে যায় তার নিজের এক সিংগারায় গোটা একটা দিন পাড় করে দেয়ার কথা। শুভ্র’র চোখে জল এসে যায় যেন। এরপর রহিমের কাছে চেখের জল আড়াল করে শুভ্র বলে,
তুই মোর সাথে চল। তোক লেহেনে আইজ মুই একটু ঘুরিম। শুভ্র রহিম কে সাথে করে তার গাড়ি নিয়ে বেড় হয়। প্রথমে সে রহিমকে নিয়ে পীর নগর যায়। সেখানে ভালো একটা হোটেলে গিয়ে রহিমের জন্য কাচ্চি সাথে চিকেন ফ্রাই আর একটা কোলড ড্রিংকস এর অর্ডার দেয়। রহিম একটু হতচকিত হয়ে পরে। এমন খাবার সে কোনো দিনই খায়নি। রহিম মজা করে খায়। আর শুভ্র’র দিকে তাকায়।
শুভ্রঃ আর কিছু লিবো রহিম?
রহিমঃ না দাদা।
শুভ্রঃ এলাও কি তুই হরিণ বিড়ি খাইস?
রহিমঃ রহিম সলাজ হেসে বলে, দুই একটা দাদা।
শুভ্রঃ তোরঠেই তো মুই বিড়ি খাবা শিখিচিনু , ঠিক না?
আসলে সেই ছোট্ট বেলায় রহিম শুভ্রদের বাসায় রাখাল হিসেবে কাজ করলেও রহিম ছিল শুভ্র’র একেবারে প্রাণের বন্ধু। রহিমের সাথে শুভ্র বনে বনে শ্যাওড়া গাছের ডালে ডালে পাখির বাসা খুঁজে বেড়াতো। পাখির ছানা দেখলে ছানাদের খাবার দিতো, আর গামছা ভিজিয়ে এনে তাদের টুপ টুপ করে পানি খাওয়তো। প্রথম প্রথম ছানাদের মা-বাবা এবং ওদের দলভুক্ত অন্যান্য পাখিরা নানা রকম কলাহলে ডানা ঝাপটিয়ে শুভ্রকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু পরে ওরা যখন বুঝতে পারলো, শুভ্র ওদের বাচ্চাদের কোনোরকম ক্ষতি করছেনা, তখন থেকে তারা আর শুভ্রকে বাধা দিতোনা। বরং নিশ্চিন্তে এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে উড়ে বেড়াতো। এমনি করেই স্কুল ফাঁকি দিয়ে কখনও বা হেমন্তে ধান কেটে, কখনও বা গরুর পাল মাঠে নিয়ে ডাংগুলি খেলে, দুর দিগন্তে সবুজের নীলিমায় অন্যরকম এক প্রাণের স্পর্শে হারিয়ে যেতো শুভ্র।
আজ রহিম কে পাশে পেয়ে সেই সকল স্মৃতি যেন নুতন করে নুতন ভাবে আলোরিত করে, আন্দোলিত করে শুভ্র’কে। আর তাই আজ শুভ্র রহিমের সাথে কিছু সময়ের জন্য হলেও নিজেকে হারিয়ে ফেলে। অতিত হাতড়াতে থাকে। নিজেকে খুঁজে পেতে চায়।
সাগুনী শাল বনের একপাশ ঘেষে বয়ে চলা নদী টাংগনের থির থিরে বয়ে চলা স্বচ্ছ কাঁচের মতো জলে। এখানে সাগুনী শালবনের পাশ ঘেঁষে থাকা বাঁশগাড়া গ্রামটিতে বাবার সাথে অনেকবার এসেছে শুভ্র। এখানে তাদের কৃষি জমিগুলো বর্গা চাষ করতো বিষ্টু-দা এবং তরুণীদের অন্য সকল জ্ঞাতি গোষ্ঠির লোকেরা। এরা সবাই সনাতন ধর্মালম্বীর। যদিও তখন আমি অনেক ছোট তোবুও এদের আন্তরিকতা এবং আতিথেয়তার কথা ভোলার মতো নয়। এখন তাদের মধ্যে অনেকেই আর বেঁচে নেই। যারা আছে তাদের কেউ আর শুভ্র’কে চেনেনা। শুভ্র’ও তেমন করে আর তাদের চিনবেনা। কারণ ঐ সময় বোনেদের বিয়ে এবং বিয়ের খরচা করতে গিয়ে সে সব জমি বিক্রি করে দিতে হয়েছে তাদের। এর পর প্রায় বিশ বাইশ বছর ধরে সেখানে আর যাওয়া হয়নি শুভ্র’র। আজ অনেক বছর পর রহিম কে কাছে পেয়ে তাকে সাথে করে সাগুনী শাবনে বেড়াতে এসেছে শুভ্র। এখানে সেই সময় রাস্তটি ছিল কাঁচা। আর এখন সেটি পাকা হয়ে গেছে। ঢাকা থেকে সরাসরি কোচ এবং দিনাজপুর থেকে পীরগন্জ লোকাল বাসগুলি হরদম চলাচল করছে। তাই দেখে বেশ ভালোই লাগছিল শুভ্র’র। পূর্ব-পশ্চিম হয়ে নদীর ওপর উত্তর-দক্ষিণে ট্রেনের লাইন। দু-পাশ্বে দুটি ব্রিজ। একটি রেল চলাচলের, অন্যটি অন্যান্য সব যানবাহন চলাচলের জন্য।
প্রকৃতির অনাবিল বহুমাত্রিক সৌন্দর্যবোধের লীলাভূমি যেন সাগুনী শালবন। আর এর পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা আমাদের এই টাঙ্গন নদী। শালবনের সবুজ পাতাগুলোর শন শন বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে টাঙ্গনের থির থিরে জল যেন দোল খেয়ে অনবরত ঢেউ তুলে অন্যরকম একটা মহোনীয়তায় সেখানকার প্রকৃতিকে গড়ে তুলেছে নয়নাভিরাম এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যবোধের লীলাভূমিতে। এক পাশে শালবন অন্য পাশে সবুজের সমারোহ। মধ্য দিয়ে বয়েচলা টাঙ্গনের জল কী অপরুপ দৃশ্যের ছন্দময় গতি তুলে বয়ে চলেছে। পাখিদের কলতানে মুখরিত হয়ে এখানেই যেন নেচে যায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রকৃতি। অপরুপ সৌন্দর্যের এক বাংলাদেশ। বলা যায় অপার সৌন্দর্যে প্রকৃতির এক টুকরো স্বর্গ ভুমি। বিকেলের সোনা রোদ টাঙ্গনের সচ্ছ জলে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গুলোতে উঁকি দেয়, তখন দেখা মেলে ভিন্নরকম এক সৌন্দর্যের পশরা। প্রকৃতি যেন তাঁর অপার মহিমা এখানে এসে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে। শুভ্র’র মন প্রাণ জুড়ে যায়।
একসময় রহিমকে কাছে কাছে ডেকে নিয়ে শুভ্র বলে, রহিম, একদিন তোরঠেই হরিণ বিড়ি খাবা শিখিচিনু আর আইজ তোক মুই কহচু আর বিড়ি খাবিনা, মহো আর সিগারেট খামনি, ঠিক আছে?
রহিম হেসে বলে, ঠিক আছে দাদা। আর বিড়ি খামনি, কথা দিনু।
শুভ্রঃ তাহিলে মোর সংগে এক সাথে সুর মিলায় কোহো, ধুম পানে বিষ পান, আর নয় ধুম পান।
রহিম শুভ্র’র সাথে একত্রে সুর মিলিয়ে বলতে থাকে, ”ধুম পানে বিষ পান, আর নয় ধুম পান“।
শুভ্র রহিমের পীঠ হাত চাপরিয়ে হা-হা করে হেসে বলে, ভালোই হইল, আইজ তোর সাথে দেখা হয় হেনে। বিড়ি সিগারেট দুইডায় দুইজনের একসাথে ছাড়া হইল, কী কহিস।
রহিমঃ আচ্ছা দাদা বিড়ি খাইলে কী খুব ক্ষতি হয়?
শুভ্রঃ হুম। অনেক ক্ষতি হয়।
রহিমঃ কী ক্ষতি হয় দাদা?
শুভ্রঃ বিড়ি সিগারেটের তাহানে নিকোটিনসহ এর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের বিষাক্ততায় ধুমপায়ী আর এর কাছত যারা থাকে তারা সহ প্রতিবছর প্রায় সত্তোর লক্ষ মানুষ মারা যায়।এইডার ভিতর ফের দুই থেকে আড়াই লক্ষ হচে ছোট ছোট শিশু। এই শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয় হেনে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এইডা ছাড়াও পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও হয়। ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর বুইচ্ছি। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় একলাখেরও বেশী নারী মরে।
রহিমঃ একটু অবাক হয়ে বলে, বিড়ির তাহানে এতো লোক মরে দাদা? যত দিন থাকে মুই বিড়ি খাচু তাতে মনডা কহচে মোর কইল্জা খানত কিছু নাই দাদা।
শুভ্রঃ থাউক এইডা চিন্তা করেহেনে আর লাভ নাই। এলা তো বাদ দিছি। কয়দিনের মধ্যে সব ঠিক হয় যাবে, বুঝা পাইছিতো?
রহিমঃ পাইছু দাদা।
শুভ্রঃ আচ্ছা রহিম অনেক তো ঘোড়াঘুড়ি হইল এইবার চল বাড়িত যাই।
রহিমঃ ঠিক আছে দাদা।
তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আস্তে ধীরে সূর্য়টা বিদায় নিচ্ছে চাঁদটােআস্তে ধীরে মাথার ঘোমটা সরিয়ে নুতন বধুর মতো উঁকি দিতে থাকে রাতের আকাশের সাথে মিলন হওয়ার আশায়। আর তাইতে আকশের তারা গুলি ফিক ফিক করে হাসতে থাকে। ঠিক এমনি একটা সময় শুভ্র তার গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রাখে। এরপর রহিম কে বলে, রহিম সেই ছোট বেলায় তো তুই অনেক গান কহচিলো। আইজ মোক একখান গান সুনাদি।
রহিম গান ধরে,
ও তুই যতই জ্বালা দিস রে কালা ততই বাড়ে প্রেমো সাধ
তোর লাইগা বে..
তোর লাইগা বে..
তোর লাইগা বেহায়া মনটা আমার করে রে উৎপাত
বেহায়া মন আমার
বেহায়া মন আমার, বেহায়া মন
শোন বলি রে প্রাণোনাথ
তোর লাইগা বেহায়া মনটা আমার করে রে উৎপাত..!
রহিম মনের ভেতর থেকে চিস্তি বাউলের গাওয়া গানটি গেতে থাকে। শুভ্র বিমুগ্ধ চিত্তে সে গান শোনতে শোনতে এক সময় তার পীরনগর,শান্তিপুরের পীঠ বরাবর বয়ে চলা নদী, ছোট্টো ’লাছির’ কিনার ঘেঁষে সুখের হাটের ছোট্ট বাংলোয় গিয়ে পৌছায়। এরপর গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলে, তোর গানডা শুনেহেনে খুব ভালো লাগিল রে রহিম। এরপর এক হাজার টাকার একটা নোট বেড় করে দিয়ে বলে, তোর বউ এর জন্য কিছু একটা কিনে লেজাইস কেমন।
রহিম যেন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। শুভ্র অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর শুভ্র জিজ্ঞেস করে কি রহিম, হাসেচি কেনে?
রহিমঃ মুই তো এলাও বিহায় করুনিগে দাদা।
শুভ্রঃ কি কহচি রে, এলাও বিহা করিসনি?
রহিমঃ না দাদা।
শুভ্রঃ কেনে, বিহা করিসনি কেনে?
রহিমঃ মুইতো লম্বায় এমনিতেই অল্প ছোট। সেই তাহানে মোক আর কেঁহো বেটি দিবা চাহেনি। তাপরও একখান বিহা ঠিক হইচিলো। বর সাজেহেনে সবায় গেনুও। কিন্তু ঐ রাইতেই শালির বেটি অন্য এক জনের হাত ধরেহেনে সেই যে পালাইল, আর কোনো খবর আইজ পর্যন্ত পাইল গেইলনি। এই দুঃখে আর কোনো বিহায় করুনি গে দাদা।
শুভ্রঃ এলা তো তুই আর আগের মত খাটো নাই। অল্প হইলেও লম্বা হইচি, এলা তো বিহা করিবা পারিস।
রহিমঃ নাহ্ দাদা, কে বিহা করিবে মোক। খাটো দেখেহেনে মাইয়ার বাপ লা তো দুরত থাউক, মাইয়ালাও বিহা করিবা চাহেনি। ফের যদি ঐরকম টাকা থাকিলো হয় তাহিলে দেখিলো হইস, মাইয়া তো মাইয়াই, মাইয়ার বাপলা সহ দৌড়াইলো হয়।
শুভ্র মনে মনে ভাবে, কারো চুল আছে তো তৈল নেই, আবার কারো তৈল আছে তো চুল নেই, হা-হা-হা। রহিমের বিয়ের প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্বেও তার জন্য কোনো কনে খুজে পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। অন্যদিকে শুভ্র’কে‘ অনেক সুন্দরী মেয়েরা ইশারায় ইংগিতে একটা কিছু জানান দিলেও শুভ্র’র তেমন করে তেমন কিছুই মনে হয়নি।
রহিমঃ আচ্ছা দাদা, একটা কাথা কহিম?
শুভ্রঃ কোহো।
রহিমঃ তুই ঢাকাত যেইঠে থাকেচিলো, ঐঠে বেলে একটা মাইয়া নিখোঁজ হয় গেইছে? হামারতিকার লোকলা তো কহচে মাইয়াডা নিখোঁজ হয়নি, তুঁহে বেলে গুম কইছি?
শুভ্রঃ মহো তো ঐরকমই শুইনচু। কিন্তু মুই এইডার বেপারে কোনো কিছুই জানুনি।
রহিমঃ মাইয়াডাক তুই দেখিচি?
শুভ্রঃ হুম। মাঝে মাঝে দেখিচু।
রহিমঃ তাহিলে মাইয়ডার কী হইল, কুণ্ঠে গেইল, নাকি ফের কেঁহো মারে ফেলাইল?
শুভ্রঃ মুই কিছু কহিবা পারুনি রে রহিম।
রহিমঃ তাহিলে তোর নামডা আসিল কেনে?
শুভ্রঃ সেইডায় তো কাথা। কেনে যে আসিল, এইডা মহো কহিবা পারছুনি। তবে মাইয়াডা অনেক বড় ঘরের, আর ধনী লোকের মেয়ে। খুব শান্তশিষ্ট আর আর যথেষ্ঠ ভদ্রও ছিলো। যেদিন হারায়, সেদিন ছিলো হরতাল। হরতালের আগের রাইতোত মুই ছিনু ময়মনসিংহ। পরের দিন হরতালের তাহানে মুই আর বাসাত আসিবাও পারুনি, আর অফিসতও যাওয়া সম্ভব হয়নি। এইতাহানেই মোক সন্দেহ করছিলো সবায়। মাইয়াডাও হরতালত হারাইল, আর মোহ ঐদিন বাসাত তো নাইয়ে, অফিসতও নাই।
রহিমঃ তোর কোনো অসুবিধা হয়নি দাদা?
শুভ্রঃ অসুবিধা আরো হয়নি। কত যে আইনের লোক, আর কতো যে জেরা, এইডা কহে হেনে শেষ করা যাবেনি।
রহিমঃ তাহিলে মাইয়াডার কি হইল, তোর কি হবে?
শুভ্রঃ কী হবে এইডা মুই কহিবা পারিমনি। তবে কয়েক বছর পর মাইয়াডার একটা খবর পাইল গেইছে, অঁয় নাকি প্যারিসের এক মুসলিম চিত্রশিল্পীর সাথে কাহাকো না জানায়হেনে, প্যারিসত চলে গেইছে। ঐঠে থাকে অঁয় অর বাবা মা’ক চিঠিও দিছে। মাইয়াডার বাবা মা খুব ভালো। হামরা চিঠিখান আদালতত দাখিলও কইছে কিন্তু দাখিল কইরলে কী হবে, পুলিশ এখনও পর্যন্ত ফাইনাল কেনো চার্জসীট পর্যন্ত কোর্টে দাখিল করেনি। এইডা হইল বাংলাদেশ বুইচ্চি।
রহিমঃ তাহিলে, এলা তোর মামলাডার কি হবে?
শুভ্রঃ কি আর হবে? কিছুই হবেনি। খালি খালি একটু হয়রানি হবে, এই আর কি।
রহিমঃ দাদা তোর তো অনেক টাকা, তুই একটু ভালো করেহেনে লরেচড়ে দেখেককিনি।
শুভ্রঃ রহিম, একটা গল্প আছে শোন, এলা দেশের যে অবস্থা, তাতে আইনের লোক যদি বনের হাতি ধরিবা যায়, তাহিলে মহিষও দৌড়ে পালায়। আর মহিষের দৌড়ানি দেখেহেনে শিয়াল মহিষক কহচে, পুলিশ তো হাতি ধরিবা আইচ্চে, তো তুই তো মহিষ, তুই দৌড়ে পালাছি কেনে? মহিষ দৌড়াইতে দৌড়াইতে কহচে এইডা বাংলাদেশ। মুই যে হাতি নাহায়, এইডা প্রমাণ করিতেই লাগিবে খুব কম করে হলেও বিশ বছর। শিয়াল এইডা সুনেহেনে এইযে দৌড় সেইডা আর কহিবার মতো নাহায়, যদি ফের তাকও ধরে ফেলায়, বুঝিলো।
এ কথা শোনে রহিম যেন সেই ছোটটির মতো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। আর হাসতে হাসতেই বলে, দাদা তুই এলাও আগের মতোই আছিস। তোর গল্প শুইনলে মোর খালি নাহায়, সবারই পেট ফাটে যাবে। কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে রহিম আবারও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে। তারপর আবারও বলে, মুই জানছিনু যে, শিয়ালও নাকি খুব চালাক।
শুভ্রঃ চালাক দেখেহেনেই তো শিয়াল লেজ গুটিয়ে দৌড়। নাহিলে ফের মহিষের কাথায় শিয়াল দৌড়ে পালায়?
রহিমঃ হা হা হা ঠিক কহিচি দাদা, শিয়াল খুব চালাক।
Tuesday, June 25, 2019
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
সুখ, ভালোবাসা, আদর
জীবনকে সঠিক পথে চলতে কষ্ট করে পড়ার অনুরোধ রইল ----------------------- ১. ঘুম থেকে উঠে নামাজ ও স্রষ্টার প্রতি আপনার আজকের প্রার্থনা করে নিন। ...
-
তবু ভালো থাকিস বল কি কি থেকে মুছে ফেলবি আমায়? তোর ল্যাপটপ, তোর প্রোফাইল। তোর ইনবক্স, তোর মোবাইল। মুছতে পারবি সেই ঠান্ডা হাসি, আদর, অভিমান...
-
(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রিয় কবিতা ) হঠাৎদেখা রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা , ভাবিনি সম্ভব হবে কোনদিন ।। আগে ওকে ...
-
হঠাৎ সেদিন কিছু না জানিয়ে রংপুর থেকে বাসায় চলে যায় রুপা। হিমু অনেকবার ফোনে চেষ্টা করেও পায়নি, বাসায় যাওয়ার পরথেকেই তার ফোনটা বন...
No comments:
Post a Comment