উৎসর্গঃ চিরচেনা "শশী" কে
আমি ছিলাম তার ভাষায় বেয়াদব জুনিয়র,তার বন্ধুরা আমাকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছে।যেমন আমাকে নিয়ে তারা হলের ছাদে চা সিগারেট খায়,গল্প গুজব করে।সারাদিন বাইকের পিছনে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।আমি সারাদিন আড্ডা দিয়ে রাতে রূমে গেলে তিনি বলতেন,কিরে বেয়াদব?তোর ঘোরাঘুরি শেষ!না আবার খেয়েদেয়ে বের হবি?আমি একটা ফ্যাকাশে হাসি দিয়ে বলতাম,ভাই!!সে বলতো,খবরদার আমাকে ভাই বলবি না। আমি কোন বেয়াদবের ভাই না। প্রায় পাঁচ বছর পরে বাপ্পা ভাইয়ের সঙ্গে দেখা।বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি আমার রূমমেট ছিলেন,তার কাজ ছিলো সারাদিন পড়াশোনা আর তার বিখ্যাত প্রেমিকা নিয়ে ক্যাফেটেরিয়া বসে গল্প করা।তার জীবন বলতে এতটুকুই,প্রেম আর পড়াশোনা!এর বাহিরে তিনি অন্যকিছু করতে নারাজ।তার বন্ধুরা ব্যাপারটা নিয়ে সব সময় আমার হাসি মসকরা করতো। একদিন তারাতাড়ি রূমে ফিরেছি,তিনি আজকে আমাকে দেখে কিছু বললেন না। আমার মনটা কেন যেন একটু খচখচ করছে,কেন এমন হলো। আমি সিগারেট প্যাকেটটা বালিশের তলায় রেখে বললাম,ভাই কোন সমস্যা? তিনি কিছুটা মলিন গলায় বললেন,তোর কাছে সিগারেট আছে রে মুরাদ? আমি চমকে উঠলাম!যে লোক চা পর্যন্ত খায় না,তিনি চাইছেন সিগারেট! তাও আবার নাম ধরে ডেকে। এই লোক তো যখন তখন আমাকে বেয়াদব টেয়াদব যা তা অবস্থা করে। আমি একটা মালব্রো লাইট বের করে দিলাম।তিনি সিগারেট ধড়ালেন।আমি বললাম,কি হইছে ভাই আপনার?তিনি বললেন, তুই প্রেম ট্রেম করিস কিছু? আমি বললাম,না ভাই করি না!আমার সাথে কে প্রেম করবে?সে কিছুটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,তোর আপুর ব্যাংকের জব টা হয়ে গেছে বুঝলি।আমি মুখটা হাসিহাসি করে বললাম,এটা তো আনন্দের সংবাদ!আপনি এতো টেনশন করছেন কেন? আপনার তো উচিত এই সুবাদে ভাইব্রেরাদারদের খাওয়া দাওয়া দেওয়া।তিনি একটা ম্লান হাসি দিয়ে বললেন,শোন যেদিন তুই বেকার হবি এবং তোর একটা আমার মতো রূপবতী প্রেমিকা থাকবে!সেইদিন বুঝবি বেকারদের চাকুরিজীবী প্রেমিকা থাকা কতোটা টেনশনের।আমি বললাম,ধুর ভাই কি যে বলেন।সে বললো,শোন মেয়েরা ছেলেদের ম্যানিব্যাগের চেহারা দেখলেই বুঝতে পারে এর অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন চলছে।আমি আর কথা বাড়ালাম না,এমনিতেই সারাদিন ঘোরাঘুরি আমি ক্লান্ত!তিনি পড়তে বসলেন। এরপর ভাই পড়াশোনা গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন।আপুর সঙ্গে কয়েকটা জব এর পরীক্ষা দেওয়ার পরেও তিনি টিকেন না কিন্তু আপু টিকে যায়।কেন এমন হয়,তিনি নিজেও জানেন না।হয়তো আমাদের বসে সঙ্গে হাসাহাসি করছেন,এমন সময় হটাৎ যদি মনে হয় তার প্রেমিকা এখন ব্যাংকার আর তিনি এখনও বেকার।সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে পড়তেন বসতেন।তার এসব কাহিনী দেখে তার বন্ধুরা বলতো,শোন এতো পেইন নিস না,পরে দেখবি এখন সিগারেট ধরেছিস!আবার কোনদিন প্রেমিকার টেনশনে গাঞ্জা ধরবি।তোর প্রেমিকা ওইদিকে ব্যাংকে বসে টাকা নাড়াচাড়া করছে!আর তুই এই দিকে পড়াশোনা বাদ দিয়ে গাঞ্জা খাচ্ছিস। ভাই এসব কথা শুনে কিছু বলতেন না,রাগি চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থেকে পড়তে বসতেন। একদিন গভীর রাতে বাহিরে থেকে রূমে ফিরছি, দেখি বাপ্পা ভাই এখনও জেগে আছেন। আমি রূমে ঢুকতেই তিনি মুখটা অন্যদিকে করলেন! আমি তার গাল ভেজা দেখতে পেলাম। নিশ্চয়ই এতোক্ষন কেঁদেছেন।আমি বিব্রতবোধ করছি। কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বললাম,কি হইছে ভাই!কি হইছে আপনার??তিনি কিছুটা শান্ত হয়ে বললেন,তোর আপুর বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ব্যাংকারের সঙ্গে আজকে সন্ধ্যায় বিয়ে হইছে। আমি কিছুটা অবাক হলাম তার কথা শুনে।বিরক্তিটা এক নিমেষেই বিস্ময়ে পরিনত হলো।আপুর মতো একজন মানুষের কাছে এমনটা কখনোই আশা করা যায় না।আমি পুরোপুরি অবাক। তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন,ভালোই হইছে বুঝলি।বেকার ছেলের এতোদিন ঝুলে থাকার মানেই হয় না।আমি কিছু বলতে পারলাম না,আমার মুখে কথা আটকে গেছে। পৃথিবীতে কেউ হঠাৎ চলে গেলে প্রথম দিকে মানুষের খুব কষ্ট হয়। মানুষ যতটা না কষ্টের কথাভেবে কষ্ট পায় তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পায় আনন্দের কথা ভেবে,একদিন সকালে দুজন পাশাপাশি বসে ছিলো কৃষ্ণচূড়া রোডে,কিংবা একদিন সন্ধায় দুজন দাড়িয়ে ছিলো ক্যাফেটেরিয়ার সামনে।আনন্দের দিনগুলোই প্রথমে মনে আসবে।এক সময় মনে হবে তাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারা যাবে না।সারাদিন শুয়ে থাকা,শুয়ে শুয়ে তার কথা মনে করা,রাতে জেগেথাকা,বুকের মাংস পেশী চিনচিন করে কাঁপুনি দিবে,খিঁচুনি দিবে।এই ব্যাপার গুলো দুটি সময় ঘটে যখন মানুষটি কাছে আসে এবং যখন চলে যায়। এর পরে বাপ্পা ভাই পুরোপুরি চেঞ্জ হয়ে গেলো। আমাদের সঙ্গে সময় দিতো,গান বাজনা হতো!তার রূমে একটা চায়ের ফ্লাক্স ছিলো ওটাতে চা ভর্তি করে নিয়ে বসতেন।আমরা সারারাত ক্যাম্পাসের বসে জ্যোৎস্না দেখতাম!লাল চোখ নিয়ে গিটার হাতে ঝিমুনি দিতাম কোন রূপবতীকে কল্পনা করে!! আমাদের সঙ্গে হয়তো বাপ্পা ভাইও ঝিমুনি দিতেন তার ব্যাংকার প্রেমিকার কথা ভেবে।কে জানে এই মেয়েটার কি বাপ্পার মতো একজন বেকার যুবকের কথা মনে পড়ে কি না?যে এখন প্রায়ই গভীর রাতে আমাদের মতো কিছু ব্যাকবেঞ্চার ছেলেদের সঙ্গে তার কথা ভেবে রাত জেগে জেগে ঝিমুনি দেয়।কে জানে?এই মেয়েটা যখন রেগুলার ব্যাংকে বসে এক হাজার টাকার চকচকে নোটগুলো নাড়াচাড়া করে,তখন কি সামান্য সময়ের জন্য বাপ্পার মতো কোন অপদার্থ বেকার যুবকের কথা মনে করে অন্যমনস্ক হয়ে যায় সামান্য সময়ের জন্য!!কেন জানে!!! এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে বাপ্পা ভাই আর আমি সেই বিশ্ববিদ্যালয় সামনে আজকে রাতে খেয়েদেয়ে বসে আছি।বাপ্পা ভাই পণ করেছিলেন আর কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় আসবেন না,কিন্তু আজকে নিয়তি ঠিকই তাকে এখানে এনেছেন।পাঁচ বছর আগে যেদিন সে চলে যান,কাউকে বলে পর্যন্ত যায় নি।রাতে রূমে এসে দেখি তিনি চলে গেছেন।শুধু শুনেছি পরের বার তিনি বিসিএস এডমিন ক্যাডার হয়েছেন!বিবাহ করেছেন,তার রূপবতী বউ ডাক্তার,নাম ডাক্তার নাজনীন সুলতানা।আজকে আমরা ডাক্তার নাজনীন সুলতানার জন্য অপেক্ষা করছি!নাজনীন সুলতানা নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে আসছেন কুড়িগ্রাম থেকে।নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বাপ্পা রহমানকে নিয়ে যাবেন রাজশাহীতে। বাপ্পা রহমান এবং তার রূপবতী স্ত্রী ডাক্তার নাজনীন সুলতানা একটু আগে আমাকে ধাপে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছেন।যাওয়ার সময় ডাক্তার নাজনীন সুলতানা মিস্টি করে হেসে বলেছেন,শুনেছি আপনার চিত্রলেখা নাকি অনেক রূপবতী!!
রূপবতী!!ভয়াবহ রূপবতীমাথা খারাপ করার মতো।ঘটনা কি সত্যি? আমি বললাম,হুম সত্যি ঘটনা সত্যি!! তিনি বললেন,আমাকে বিয়েতে দাওয়াত করবেন কিন্তু!!আমি সামান্য হেসে শুধু বললাম,অবশ্যই!!হয়তো আরো কিছু বলা দরকার ছিলো কিন্তু কিছু বলি নি।কেন বলি নি,নিজেও জানি না।মাঝেমধ্যে কাউকে খুশি করার জন্য কিছু বলতে ইচ্ছে করে না!নির্জীব হতে ইচ্ছে হয়।ইদানীং আমিও বেকার হয়েছি,আমার এখন আর কোন কাজ থাকে না।মাঝেমধ্যে হটাৎ হটাৎ প্রথম দিকের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রাত জাগা ঝিমুনি গুলো মিস করি!!আড্ডাগুলো মিস করি!!একটা নস্টালজিক ভূত এসে মাথায় ভর করে।বাপ্পা ভাই,তার ব্যাংকার প্রেমিকের গল্প!আর কিছু আবেগহীন যুবকের একদলা অভিমানী পথ চলা..........................................
https://www.facebook.com/profile.php?id=100009159829300
No comments:
Post a Comment